ডায়াবেটিস চিকিৎসায় মুখরোচক বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীদের ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে একদল অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, পাতার গুঁড়া ও ডায়েট পদ্ধতি কথা বলে রোগীদের জীবন হুমকির মুখে ফেলছেন বলে দাবি করেন তারা।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসেকে সামনে রেখে অ্যাসোসিয়েশন অফ ক্লিনিক্যাল এনডোক্রাইনোলজি এন্ড ডায়বেটোলজিস্ট অব বাংলাদেশ (এসিডবি)’র পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা।
স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এমডি ফরিদ উদ্দিন বলেন, রোগীর ডায়াবেটিস কমাতে ওষুধের বিকল্প হিসেবে সজনে পাতা, এই পাতা ওই পাতার গুঁড়াসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ বিক্রি করা হয় বাজারে যা আমাদের মেডিকেল গবেষণার বাইরে। আবার অনেকে বিভিন্ন ধরনের ডায়েটের কথা বলেন, দুই ঘণ্টা পর পর খেতে বলেন। এই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে অনেক রোগী অসুস্থ হয়ে আমাদের কাছে আসেন। কিন্তু অনেক সময় দেরি হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, এসব পদ্ধতি মুখোরচক ও অবৈজ্ঞানিক। ডায়াবেটিস রেগীরা নিয়মমাফিক জীবনযাপন করলেই সুস্থ থাকবেন, যার মধ্যে ওষুধও একটি অংশ। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ, পরিমিত ব্যায়াম , রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করলেই সুস্থ থাকতে পারবেন।
সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন এসেডবির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস এখন এক মহামারি রোগ। আজ থেকে দুই দশক আগেও ডায়াবেটিস ছিল খুবই স্বল্প পরিচিত, অথচ আজকের দিনে শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, বরং উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত বিশ্বেরও বহুল আলোচিত স্বাস্থ্য সমস্যা এই ডায়াবেটিস। শুধু শহরাঞ্চল নয়, গ্রামীণ জীবনেও ডায়াবেটিসের মাত্রা বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটির মতো এবং ২০৩০ সালের মধ্যে হয়তো ছাড়িয়ে যাবে ৬০ কোটি। বাংলাদেশে সত্তরের দশকে ডায়াবেটিসের প্রবণতা ছিল মাত্র দুই শতাংশের মতো, সেখানে আজ তা ঢাকা শহরেই প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁয়েছে এবং প্রিডায়াবেটিস (ডায়াবেটিসের আগের ধাপ) এর হার প্রায় আরও ১০ শতাংশ।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলেও এর সামগ্রিক প্রবণতা ৫-৮ শতাংশের মতো। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার আমাদের দেশে উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মধ্যে মেদ ভুড়ির হার বাড়া এবং কায়িক পরিশ্রমের প্রতি অনিহার কারনে ডায়াবেটিসের হার দিনে দিনে বাড়তেই থাকবে। এভাবে ক্রমেই ডায়াবেটিস বাড়তে থাকলে শুধু ডায়াবেটিসের কারণেই দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য হবে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
ডায়াবেটিসের প্রতিকার এবং প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই উল্লেখ করে সম্মেলনে বক্তারা জানান, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার কারণে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিউর অন্ধ হয়ে যাওয়া, পায়ে পচন, এমনকি পা কেটে ফেলা পর্যন্ত লাগতে পারে। এত বড় বৈশ্বিক এই জটিল স্বাস্থ্য সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে তাই দরকার জনসচেতনতা এবং জনসম্পৃক্ততা। সময় মতো ইন্টারভেনশন (খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন) এর দ্বারা প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, অধ্যাপক ডা একেএম আমিনুল ইসলাম, অধ্যাপক ডা. মীর মশাররফ হোসেন, অধ্যাপক ডা রুহুল আমিন প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনটি মডারেট করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম এ হালিম খান।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সাড়ম্বরে উদযাপিত হচ্ছে, ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘ডায়াবেটিস ও সুস্থতা’ স্লোগানটিই বলে দেয় স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপনের সঙ্গে রয়েছে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধের নিবিড় সম্পর্ক। আর এতে সুরক্ষিত হবে আগামী প্রজন্ম। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা বলতে চাই ‘সবার জন্য ডায়াবেটিসের সু-চিকিৎসা এবং সেবা নিশ্চিতকরন : এখন নয়তো কখন’।