অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বেশকিছু বড় কাজ হয়েছে। কাজগুলো তড়িঘড়ি সম্পন্ন করতে গিয়ে কিছু বিষয়ে বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ডিসি নিয়োগে দুই দফায় কোটি কোটি টাকা ঘুস লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি তদন্তে তিন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সচিব, জেলা প্রশাসক এবং বিদেশে পদায়নেও ভুল ধরা পড়েছে। তবে বড় কাজগুলোর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কারে গঠন করা হয়েছে কমিশন। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়।
এছাড়া প্রতিবছর সব সরকারি কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী দাখিল, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। অবসর ও ওএসডি বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের ফলে শূন্যপদে সচিব নিয়োগ, তিন স্তরে (উপসচিব, যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব) ৪৬০ জন বঞ্চিত কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৬০ শতাংশের পদায়ন এবং সাবেক সরকারের দেওয়া ৮০ কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। নতুন করে ৩৫ কর্মকর্তাকে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, ৫১ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ এবং বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কমিটি করে তদন্ত করেছে মন্ত্রণালয়টি।
দ্রুত ব্যাপকভিত্তিক কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে গিয়ে কিছু ভুল-ভ্রাান্তিও ঘটেছে। যা প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। বিশেষ করে ডিসি নিয়োগ দিতে গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। কাজগুলো সচেতনতা এবং সাবধানতার সঙ্গে সম্পন্ন করলে অনাকাক্সিক্ষত বিষয়গুলো এড়ানো যেত বলে মনে করেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কম সময়ে ব্যাপকভিত্তিক কাজ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সব কাজ ধীরস্থিরভাবে ভেবেচিন্তে করতে হবে। কাজের গতি আরও বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস-উর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের অর্জনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হবে। সেখানে বিস্তারিত কাজের বিবরণ দেওয়া থাকবে। তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, অল্প সময়ে যে কাজ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় করেছে তা সন্তোষজনক। যে কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে তার মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্ট বিতর্ক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিরাট বড় অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। যদি সতর্কতা এবং সাবধানতা অবলম্বন করা হতো, তাহলে বিতর্ক এড়ানো অসম্ভব ছিল না। তিনি আরও বলেন, সব কাজ ধীরেসুস্থে ভেবেচিন্তে সম্পন্ন করতে হবে। কাজের গতি বাড়াতে হবে। আবার কাজের গতি বাড়াতে গিয়ে ভুলভাল করা যাবে না।
জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৮ সালের পর এই প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নিচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, সরকারি কর্মচারীর ওপর নির্ভরশীল স্ত্রী, সন্তানের সম্পদ বিবরণী চেয়েছে সরকার। দীর্ঘ ১৬ বছরের মধ্যে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার বিধান অনুসারে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হয়নি। অথচ আচরণবিধিতে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি উল্লেখ করে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নিয়ম রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘ সময় ধরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন করছে চাকরিপ্রত্যাশীরা। সরকার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সচিব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে। আগামীকাল (বুধবার) কমিটি সরকারের কাছে চাকরিতে প্রবেশের যৌক্তিক বয়সসীমা সংক্রান্ত সুপারিশ পেশ করার কথা । গত দুই মাসে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ৮০ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারের মুখ্য সচিব, সিনিয়র সচিব, সচিব ও সচিব পর্যায়ের (গ্রেড-১) কর্মকর্তারা আছেন।
এ সময়ের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব ও সাতজন সিনিয়র সচিবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অবসর, ওএসডি কিংবা চুক্তি বাতিলের ফলে শূন্যপদে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রশাসনে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগে কোনো সচিব নেই। জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সুরক্ষা সেবা বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত ড. আবদুল মোমেনকে। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশনে সদস্যের একটি পদ শূন্য রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও সদস্য ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। টেকনিক্যাল পদের চুক্তিও পর্যায়ক্রমে বাতিল হবে। বিষয়গুলো নিয়ে কাজ চলছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত দুই মাসে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে ১২১ জন, উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে ১৩৩ জন এবং যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে ২০৬ জন অর্থাৎ তিন স্তরে ৪৬০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতিপ্রাপ্তরা বিগত সরকারের সময়ে অজ্ঞাত কারণে পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের প্রায় ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে পদায়ন করা হয়েছে। বাকি প্রায় ৪০ শতাংশের পদায়ন নিয়ে কাজ চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে গত ১০ সেপ্টেম্বর লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সব পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডিসিদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ডিসি নিয়োগের লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের ফিটলিস্ট তৈরির কার্যক্রম হাতে নেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। দীর্ঘ ২০ দিন পর ডিসির ফিটলিস্ট চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ৯ সেপ্টেম্বর ২৫ জেলায় ডিসি নিয়োগের জিও জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় ওই তালিকার একজনের নিয়োগ বাতিল করে নতুন করে আরেকজনকে ডিসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর ৩৪ জেলায় ডিসি নিয়োগের জিও জারি হয়। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় ওই তালিকা থেকে আটজনের নিয়োগ বাতিল করা হয়। দুই দিনে ৯ জন নতুন ডিসির নিয়োগ বাতিল করা হয়। ১০ সেপ্টেম্বর জারি করা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া ৮ জেলার ডিসি পদ এখনো শূন্য। বর্তমানে ৫১ নতুন ডিসি কাজ করছেন। আগের সরকারের নিয়োগ পাওয়া ৫ ডিসি এখনো মাঠে কর্মরত। ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর ডিসি নিয়োগে বিগত সরকারের সময় পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের নাম না থাকায় তারা মাঠ প্রশাসনে যুগ্মসচিব কেএম আলী আজমের ওপর চড়াও হন। এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।
বিষয়টি তদন্তে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আকমল হোসেন আজাদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে ১৭ উপসচিবকে দোষী করে শাস্তির সুপারিশ করেন আকমল হোসেন আজাদ। এছাড়া ডিসি নিয়োগে প্রথমে ৩ কোটি টাকার ঘুস গ্রহণের অভিযোগ ওঠে সংশ্লিষ্ট যুগ্মসচিব ড. মো. জিয়াউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে। অবশ্য তদন্তে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পরে ডিসি নিয়োগে ১০ কোটি টাকা ঘুস গ্রহণের অভিযোগ ওঠে খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের বিরুদ্ধে। অবশ্য ঘুস গ্রহণের অভিযোগ সচিব প্রত্যাখ্যান করেন। বিষয়টি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদেও বিস্তারিত আলোচনা হয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি তদন্তে তিন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। একটি কমিটি গঠন করে ১০ কোটি টাকা ঘুস নেওয়ার অভিযোগ তাদের তদন্ত করার কথা ।
গত ৩ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা প্রেস সচিব মো. সফিকুল আলম ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নে বলেন, তিনজন উপদেষ্টা বিষয়টি তদন্ত করবেন। তদন্ত কমিটিতে সিনিয়র সাংবাদিকদের রাখা হবে। তদন্তে যে পক্ষ দোষী হবেন তার বা তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার। তবে তদন্ত কমিটি কবে হবে সে বিষয়টি তখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান তিনি। গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ কোটি টাকা ঘুস লেনদেনের বিষয়ে এখনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। এ ধরনের ঘটনা প্রশাসনের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে গিয়ে বাছবিচার না করেই আদেশ জারি করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতে দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা চাকরিতে ঢুকে পড়ছেন। বিশেষ করে খাদ্য ক্যাডারের ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা এলাহী দাদ খানকে সিনিয়র সচিব হিসাবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়। অথচ তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি। খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ কেলেঙ্কারির কারিগর। অবশ্য পরে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত হিসাবে খোরশেদ আলম খাস্তগীরকে নিয়োগ দিয়ে তা কয়েকদিনের মাথায় বাতিল করা হয়। তার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিগত আন্দোলনের বিরোধিতার নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সিনিয়র সচিব, ডিসি ও রাষ্ট্রদূত নিয়োগের বিতর্কিত উদ্যোগে প্রশাসনের অনেক অর্জন ম্লান করেছে।
এছাড়া অতীতের ধারাবাহিকতায় এবারও জনপ্রশাসন সংস্কারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সচিব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তবে কমিশন এখনো কাজ শুরু করেনি।