৪০ কোটির মধ্যে ৩০ কোটি বই ছাপানো বাকি
নতুন বইয়ের ঘ্রাণ ও পাঠদান শুরু করতে অপেক্ষায় আছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থী। অথচ এখনো অধিকাংশ বই ছাপানো বাকি রয়েছে। এবার স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর জন্য ৪০ কোটি বিনামূল্যের বই ছাপানোর কথা রয়েছে। এতে সব মিলিয়ে ১০ কোটি বই ছাপানোর কাজ শেষ হলেও আরও ৩০ কোটি বই ছাপানো বাকি রয়েছে। ফলে বছরের শুরুতেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বই হাতে পাবে না। এদিকে খরচ সাশ্রয় করতে এবার বই উৎসব না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
মুদ্রণসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত এ সময় নতুন শিক্ষাবর্ষের সব বই ছাপানো শেষ হয়ে থাকে। সেখানে বেশকিছু শ্রেণির বই ছাপা শুরুই হয়নি। এছাড়া বই ছাপানোর জন্য বাজারে পর্যাপ্ত কাগজের সরবরাহ নেই। কাগজ মালিকরা একধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। বছরের শুরুতে কিছু বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছানো সম্ভব হলেও সব বই ছাপা শেষ হতে মার্চ পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। ফলে জানুয়ারির শুরুতেই সব শ্রেণিতে বই দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এনসিটিবির সদস্যদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। বই বিতরণ যত দেরি হবে, শিক্ষার্থীদের তত ক্ষতি হবে। শুরু থেকে নীতিনির্ধারকরা একধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন। শিক্ষাক্রম আগে নাকি পাঠ্যপুস্তক আগে, সেটি ঠিক করতে গিয়ে সময়ক্ষেপণ হয়েছে। শিক্ষাক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও আমরা ফিরে গিয়েছি আগের কারিকুলামে। এতে বিশ্ব এগিয়ে গেলেও আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একধরনে মানসিক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। তারা একধরনের ট্রমার মধ্যে সময় পার করছেন। এখন তাদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার সময় হলেও সেই পরিবেশ তৈরি হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই যথাসময়ে দিতে না পারলে তাদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে আকৃষ্ট করতে হবে। পড়াশোনার অংশ হিসাবে তাদের এসব কার্যক্রমে অভ্যস্ত করাতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবক সমাবেশ করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে তিন মাস দেরিতে শুরু হয় নতুন শিক্ষাবর্ষের বইয়ের কার্যক্রম। এরপর শিক্ষা কারিকুলামে আনা হয় ব্যাপক পরিবর্তন। নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে এবার পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে ২০১২ সালে প্রণীত সৃজনশীল কারিকুলাম। এতে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সমন্বয় কমিটি গঠন করা হলেও ১৩ দিনের মাথায় সেটি বাতিল করা হয়। এছাড়া এনসিটিবির বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ সব সদস্য নতুন হওয়ায় এসব কার্যক্রম ছিল ধীরগতি। এতেও বেশ সময়ক্ষেপণ হয়েছে। এছাড়া পরিমার্জন ও সংশোধন কমিটি নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। এবার প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে জাতীয় সংগীত ও পতাকা ছাপানো হয় বইয়ের শেষে। এটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। সবকিছু মিলে একধরনের হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে। সামনে যে কয়দিন সময় আছে, এর মধ্যে ৩০ কোটির মতো পাঠ্যবই ছাপানোর সক্ষমতা দেশের মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের নেই। এছাড়া এ সময়ে চাহিদামতো মানের এত কাগজ পাওয়া নিয়েও কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বইয়ের ছাপানোর কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চতুর্থ আর পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপানো শুরু হয়েছে গত সপ্তাহে। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির প্রথমে তিনটি (বাংলা, গণিত ও ইংরেজি) বই ডেলিভারি দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো বেশির ভাগ ছাপানো বাকি রয়েছে। এছাড়া নবম ও দশম শ্রেণির সব বইয়ের ছাপানো চুক্তি শেষ করে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাণ্ডুলিপি দেবে এনসিটিবি। এরপর ছাপানোর কাজ শুরু হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নির্ধারিত সময়ে বই না পাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। তবে বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলা ও শরীরচর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শিক্ষার্থীরা মোবাইল নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। বই হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তাদের খেলাধুলা ও কো-কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিস নিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। যদি শিক্ষার্থীদের বই পেতে খুব দেরি হয়, সেক্ষেত্রে সিলেবাসও সংক্ষিপ্ত করতে হবে। পাশাপাশি তাদের হাইজেনিক বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের কিছুটা হলেও ক্ষতি কমে আসবে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, বছরের শুরুতেই প্রাথমিকের পর্যায়ে প্রত্যেক শ্রেণিতে সব বই দেওয়ার চেষ্টা করছি। মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রত্যেক শ্রেণিতে তিনটি করে বই দেওয়ার কাজ চলছে। পাশাপাশি যেসব শ্রেণির ছাপানো চুক্তি বাকি রয়েছে, সেগুলোও দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া যেসব বইয়ের পরিমার্জন ও সংশোধন রয়েছে, সেগুলোও দ্রুত দেওয়া হবে। যথাসময়ে এ কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। শিক্ষার্থী সব বই কবে হাতে পাবে, এ বিষয়ে তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই সব শ্রেণির সব বই দেওয়া সম্ভব না হলেও শিক্ষার্থীদের কিছু বই দেওয়া হবে। তাছাড়া কাগজ সংকট নিয়ে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো সত্য নয়। নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানোর জন্য প্রেস মালিকরা এসব অভিযোগ তুলছেন।
আগামী শিক্ষাবর্ষের নতুন বইয়ের কাগজের ওজন ৭০ গ্রাম থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮০ গ্রাম। আর উজ্জ্বলতা ৮০ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ৮৫ শতাংশ। নতুন বছরের জন্য শুরু থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৪০ কোটি নতুন বই ছাপানো হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী বইয়ের মান ঠিক থাকবে কি না, তা নিয়ে একধরনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, বইয়ের কাগজের মান নিয়ে আমরা সচেতন। কোনো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনসিটিবি কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ শিক্ষার্থীর জন্য ৯৬৪ লটে ছাপা হবে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। এর মধ্যে প্রাথমিকের ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫ কপি বই। অন্যদিকে মাধ্যমিকের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। এর মধ্যে ইবতেদায়ি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বইও যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ব্রেইল বই রয়েছে সাড়ে ৮ হাজার।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, পাঠ্যবই পরিমার্জনের কাজে দেরি, নতুন কনটেন্ট যুক্ত হওয়া, বইয়ের কাভারে ব্যবহারের জন্য গ্রাফিতি নির্বাচনসহ বিভিন্ন কারণে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মাধ্যমিকের সব বই ছাপার কাজ শেষ হচ্ছে না। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীরা যাতে কিছু বই হাতে পায়, সেই চেষ্টা করছে এনসিটিবি। সেজন্য ষষ্ঠ থেকে দশম-প্রত্যেক শ্রেণির তিনটি বই আগে ছাপানোর চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান যুগান্তরকে বলেন, এখনো নবম-দশম শ্রেণির সব বই ছাপানোর চুক্তি শেষ হয়নি। এসব শ্রেণির কেবল নোহা পেয়েছে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এনসিটিবি ওয়ার্ক অর্ডার ঠিক না করে ডেলিভারির সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে, যেটি অযৌক্তিক। এছাড়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ছবি ছাপানো নিয়ে জটিলতা রয়েছে। তবে আমরা দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। এদিকে পেপার মিলগুলো সিন্ডিকেট করে কাগজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি টন কাগজে ২০ হাজার টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। আর্ট কার্ডে প্রতি টনে ৪০ হাজার টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। এতে এনসিটিবির উৎপাদন শাখার কোনো তৎপরতা নেই। এ বিষয়ে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।
আপনার মতামত লিখুন