সাতক্ষীরা-৪ আসনের পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে শ্যামনগরে সমালোচনার ঝড় :বিক্ষোভ মিছিল

সাতক্ষীরা-৪ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসসংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শ্যামনগরের সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে শ্যামনগর পৌরসভায় এসব কর্মসূচি পালিত হয়।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সাতক্ষীরার ২টি আসনসহ দেশের মোট ৩৯টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল খবরটি ছড়িয়ে পড়লে শ্যামনগরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে শুরু হয় আলোচনা–সমালোচনা । রাত সাড়ে আটটার দিকে শ্যামনগর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে শতাধিক মানুষ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় তাঁরা ‘নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মানি না, মানব না’, ‘শ্যামনগর আসন ছিল, শ্যামনগর থাকবে’, ‘পুনর্গঠন সিদ্ধান্ত বাতিল কর, করতে হবে’ স্লোগান দিতে থাকেন।
পরে জেসি কমপ্লেক্স চত্বরে পথসভা করে বিক্ষোভকারীরা অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনের আসন পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানান। এ সময় বক্তব্য দেন সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ড.মনিরুজ্জামান, উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সোলায়ামন কবীর, জেলা বিএনপির সদস্য জি এম লিয়াকত আলী, সাবেক চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান, যুবদল সভাপতি শফিকুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
সাতক্ষীরার চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে দুটির আসন পুনর্বিন্যাস করে প্রাথমিক গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। পুনর্বিন্যাস করার আগে সাতক্ষীরা-৪ আসনটি শ্যামনগর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা ও পাশের কালীগঞ্জ উপজেলার একাংশের ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ছিল। এবার পুনর্বিন্যাস করে শ্যামনগর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা ও আশাশুনি উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে সাতক্ষীরা-৪ আসন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, শ্যামনগর উপজেলার সঙ্গে আশাশুনি উপজেলার সরাসরি যোগযোগ নেই। শ্যামনগর থেকে আশাশুনি যেতে হলে কালীগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে অথবা নৌকায় বিশাল খোলপেটুয়া নদী পার হয়ে যেতে হয়।
অন্যদিকে সাতক্ষীরা-৩ আসনে ছিল আশাশুনি উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন, দেবহাটা উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন ও কালীগঞ্জ উপজেলার একাংশ ৪টি ইউনিয়ন। পুনর্বিন্যাস করে কালীগঞ্জ উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও দেবহাটা উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে সংসদীয় আসন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের সুন্দরবনঘেষা বৃহৎ উপজেলা শ্যামনগর একটি পৃথক সংসদীয় আসন সাতক্ষীরা -৫ ছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন নতুন সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস করে শ্যামনগর আশাশুনীকে সাতক্ষীরা ৪ আসন হিসেবে খসড়া তালিকাভুক্ত করে। এটি নিয়ে সে সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং সচেতন ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিলে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা খুলনায় একটি শুনানী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন। বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে নির্বাচন কমিশন শ্যামনগর ও আশাশুনীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিবেশ বিদ্যমান থাকায় শ্যামনগরের ১২টি ইউনিয়ন ও কালীগঞ্জের কাকশিয়ালী নদীর দক্ষিণ পাশের কালীগঞ্জের ৮টি ইউনিয়ন সর্বমোট ২০ টি ইউনিয়ন নিয়ে সাতক্ষীরা ৪ আসন গঠিত হয়। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন ৩০ জুলাই”২০২৫ একটি বিজ্ঞপ্তিতে ২০০৮ সালে পূর্বের ন্যায় শ্যামনগর ও আশাশুনী উপজেলাকে
সাতক্ষীরা সংসদীয় ৪ আসন নিয়ে যে নতুন রুপরেখা দিয়েছে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এখানে নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত শর্ত ঞ এবং ট অনুসরণ করা হয়নি।কালিগঞ্জ উপজেলার ভৌগোলিক অখন্ডতার কারণ দেখিয়ে ২০০৮ সালে শ্যামনগর এবং আশাশুনি সাতক্ষীরা চার আসন হিসেবে নির্বাচন কমিশনের খসড়া বিজ্ঞপ্তিতে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে উপজেলার আংশিক অংশ নিয়ে নির্বাচনী এলাকা গঠিত হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার ভৌগলিক অখন্ডতা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। তদপুরি প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি।
শ্যামনগর উপজেলা বাংলাদেশের একটি সর্ববৃহৎ উপজেলা এর সাথে যোগ করা হয়েছে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনী উপজেলা এই দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে সাতক্ষীরা সংসদীয় ৪ আসন। এই দুটি উপজেলা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতবিক্ষত হয় এইসব জনপদ । এই দুটি উপজেলার সঙ্গে সরাসরি কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই এক উপজেলার থেকে আরেক উপজেলায় যেতে সময় লাগে প্রায় চার ঘন্টা।পার্শ্ববর্তী কালীগঞ্জ উপজেলার কাকশিয়ালী নদীর উপর দিয়ে সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া শ্যামনগর ও আশাশুনির মধ্যে যোগাযোগের অন্য একটি ব্যবস্থা আছে শ্যামনগরের উপর দিয়ে বহমান খরস্রোতা খোলপেটুয়া নদী পার হয়ে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের একটি ছোট করিডোর যা বাস্তবতার সঙ্গে কোনমতেও মানানসই নয়। শুধুমাত্র মানচিত্রে সংযুক্ত থাকলেও বাস্তবিক অবস্থা অনেকটা ভিন্নতর। নির্বাচনের সময় এই নদী পারাপার হতে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকবে নির্বাচনের প্রার্থী ও কর্মী সমার্থকরা। বড় নদী পারাপারে যেকোনো সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। এমনিতেই সামান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই দুই উপজেলার নদী পারাপারের নৌযান বন্ধ হয়ে যায়।এর আগে শ্যামনগরের ১১ইউনিয়ন ১টি পৌরসভা ও কালিগঞ্জ উপজেলার ৮ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ছিল সাতক্ষীরা সংসদীয় ৪ আসন এখানে মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ছিল। সে কারণে সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলা ও কালীগঞ্জের আংশিক নিয়ে সাতক্ষীরা সংসদীয় ৪ আসন সঠিক ছিল বলে জনপদের মানুষ মনে করে ।বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের চারটি রেঞ্জের একটি শ্যামনগরে অবস্থিত হওয়ায় শ্যামনগর বাংলাদেশের বৃহত্তম উপজেলা। পূর্বে শ্যামনগর এলাকা নিয়ে সাতক্ষীরা ৫ আসন গঠিত ছিল। নতুন সীমানা নির্ধারণের ফলে ভোটারদের প্রতিনিধিত্বে চরম বৈষম্য সৃষ্টি হবে এতে ভোটাধিকার ক্ষুন্ন হবে। শ্যামনগর দেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা হওয়া সত্ত্বেও পূর্বের মতো পৃথক আসন না রেখে আশাশুনী উপজেলার সঙ্গে একীভূত করায় জমমনে দারুন অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার মানুষের দাবি আগের সীমানা পুনঃ নির্ধারণ করা হোক অথবা শ্যামনগরকে একটি স্বতন্ত্র আসন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হোক। খসড়া প্রকাশের পর থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগকে মাধ্যমে চলছে ব্যাপক সমালোচনার ঝড়।
নির্বাচন কমিশনের নতুন সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটিয়ে আগের সিদ্ধান্তে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন শ্যামনগরবাসী।
আপনার মতামত লিখুন