মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
ইসলামে মানবাধিকার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়। মানবাধিকারের বিষয়টি ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বত্র সমান। মানবজাতিকে ইসলাম গৌরব, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইসলাম মানুষকে সমান অধিকার, একতা, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। ইসলামে বংশ মর্যাদা, শ্রেণি বিভেদ, জাতিগত বিভেদ ও বর্ণ বিভেদ থেকে সতর্ক করেছে। দাস-দাসী ও অধীনস্থদের প্রতি সুন্দর ও ন্যায়ানুগ ব্যবহার করতে শিক্ষা দিয়েছে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষ হিসাবে সবাই সমান মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। মৌলিক অধিকার সবার সমান। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকারও সবার ক্ষেত্রে সমান। ব্যক্তি স্বাধীনতাও সবার ক্ষেত্রে সমান। মর্যাদার দিক দিয়ে ইসলামে ধনী-গরিব সবাই সমান। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারও সবার ক্ষেত্রে এক। জানমালের নিরাপত্তার অধিকার একই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্থাৎ বাক-স্বাধীনতা সবার ক্ষেত্রে এক। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ইসলামে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যুগে যুগে মানবতার মুক্তি ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার আশাবাদ শুনিয়েছেন বিভিন্ন মহামানব। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সপ্তম শতকে হাজির হয়েছিলেন মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে নতুন ধারণা নিয়ে। তিনি প্রচার করেছেন মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি ও মানুষকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলাম বর্ণ, গোত্র, ভাষা, সম্পত্তি বা অন্য কোনো মর্যাদার প্রতি গুরুত্বারোপ করে না। এটি একটি সমন্বিত ধারণা।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামই প্রথম স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রদান করেছে। ইসলামে মানবাধিকার বলতে সেসব অধিকারকে বোঝানো হয়, যেগুলো স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তার বান্দাকে প্রদান করেছেন। পৃথিবীর কেউ তা রহিত করার অধিকার রাখে না। এ অধিকার কখনো রহিত হওয়ার নয়, ইসলামের প্রথম যুগে মদিনাভিত্তিক সমাজে মুসলিম নাগরিকরা সামাজিক, আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সব অধিকার ভোগ করতেন। ইসলামে ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে রয়েছে জীবনের নিরাপত্তা, নারীর অধিকার, হত্যা না করা, গিবত না করা, ক্ষমা প্রদর্শন, সদাচরণ, রাজনৈতিক অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, ব্যক্তিগত অধিকারসহ অনেক কিছু। সামাজিক অধিকারের মধ্যে রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মালিকানার অধিকার, সাম্যের অধিকার, চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার, লেখা, বলা ও প্রচার কার্যের অধিকার। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-আমি মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও চমৎকার অবয়বে সৃষ্টি করেছি। (সূরা-আত তিন-০৩)। আরও বলা হয়েছে-তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে বাছাই করা হয়েছে, মানবের কল্যাণের জন্য। (সূরা-আল-ইমরান-১১০)।
মানুষে মানুষে সাম্যের ধারণাটি পাওয়া যায় অন্য আয়াতে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, হে মানুষ, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক নর ও নারী থেকে। (সূরা হুজরাত-১৩)। ইসলামের শান্তির বাণী শুধু নিজ ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং পরমত ও পরধর্মের প্রতি সহনশীলতা ও সহানুভূতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্যে গুরুত্ব দেন রাসূল (সা.)। উম্মাহর ধারণার মধ্যে অন্যান্য ধর্মের স্বাধীনতা ও অধিকার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাসূল (সা.)-এর সময়কালে করা চুক্তিগুলো দেখলে সেটি বোঝা যায়। হিজরি ৬২৪ সালের ‘মদিনা সনদ’ মানবাধিকারের স্বীকৃতির জন্য বিখ্যাত। এ সনদে ৪৭টি ধারা ছিল। ধারাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায়গুলো সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি জাতি গঠন করবে। পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে। মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়ের লোকরা বিনা দ্বিধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। রক্তপাত, হত্যা, ব্যভিচার এবং অপরাপর অপরাধমূলক কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হলো। দুর্বল ও অসহায়কে সর্বতোভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে। ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। নবুয়তপ্রাপ্তির আগে হজরত আব্বাস (রা.)-সহ অন্যদের নিয়ে গঠিত হিলফুল ফুজুল ছিল বর্ণবাদে আক্রান্ত অন্ধকার আরবে মানুষের স্বাধীনতা ও বেঁচে থাকার অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি। রাসূল (সা.) তার বিদায় হজের ভাষণে অন্যান্য অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে দাস-দাসীদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। সেখানে বলা হয়েছে-মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই সমান। তিনি বলেন, কোনো আরবের ওপরে অনারবের প্রাধান্য নেই। প্রাধান্য নেই কোনো অনারবের আরবের ওপর। সাদা মানুষের প্রাধান্য নেই কালো মানুষের ওপর। রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর এ ধারা অব্যাহত ছিল। যেমন হজরত আবু বকর (রা.) তার প্রথম ভাষণে বলেন, ‘আমি সৎপথে থাকলে আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন এবং সমর্থন জোগাবেন, আর বিপথগামী হলে উপদেশ দিয়ে পথে আনবেন।’ হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালেও প্রত্যেক পুরুষ ও মহিলার পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত ছিল। শাসনসংক্রান্ত ব্যাপারে তারা তাদের নিজস্ব অভিমত, অভিযোগ, বিকল্প প্রস্তাব ইত্যাদি পেশ করতে পারতেন। মানুষের সম্মান কোনো বর্ণ-গ্রোত্র দ্বারা নির্ধারিত হবে না। বরং আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা বা তাকওয়া নির্ধারণ করবে ব্যক্তির মর্যাদা। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে-‘আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান হলো যারা, তাকে ভয় করে।’ (সূরা-আল হুজরাত)।
আজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গঠিত হয়েছে মানবাধিকার কমিশন। এসব কমিশন নিজ নিজ দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি আজ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র ক্রমাগত ঘটেই চলছে। আজকের আধুনিক সভ্য যুগে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারকে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে মহানবি (সা.) অজ্ঞতা ও অন্ধকার যুগে কলুষিত সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শতভাগ সফল হয়েছিলেন।
মুসলমানরা উত্তর আফ্রিকায় সাম্রাজ্য বিস্তার করলে সেখানকার বরবর জাতির মতো দুর্ধর্ষ ও হিংস্র জাতির মধ্যেও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানরা স্পেন বিজয় করলে ইউরোপ ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত সামন্ত রাজাদের দুঃশাসন ও অত্যাচারের হাত থেকে সেখানকার সাধারণ মানুষ মুক্ত হয়। তারা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
এ ছাড়া মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশের বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বর্ণবাদ ও কুসংস্কার দূরীকরণেও ইসলামের ভূমিকা অপরিসীম। অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম যখন যেখানে বিস্তৃত হয়েছে, সেখানেই সব অনাচার, কুসংস্কার, বৈষম্য ইত্যাদি দূরীভূত হয়েছে এবং মানুষ তার ন্যায্য অধিকার ভোগ করেছে।
সমাজে মর্যাদার সঙ্গে বাস এবং জানমালের হেফাজত করা হচ্ছে একজন মানুষের সামাজিক অধিকার। ইসলাম কাউকে কারও মর্যাদা হরণ ও অন্যায়ভাবে হত্যার অনুমোদন দেয় না। আল্লাহ বলেন-‘অন্যায়ভাবে কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল।’ হাদিসে বলা হয়েছে-‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ এমনকি যুদ্ধের সময় বিরোধী পক্ষের নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে ভালো আচরণের কথা বলা হয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, সমাজে যখন ইসলামের শান্তিপূর্ণ বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন পরিপূর্ণরূপে পালিত হবে এবং সামগ্রিকভাবে তা বাস্তবায়িত হবে, তখন মানুষ আর অধিকারবঞ্চিত থাকবে না। তাই এভাবে মহানবি (সা.) মানবতার বার্তা নিয়ে এ ধরাধামে আগমন করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তা কাল থেকে কালান্তর মানব ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে; আর ইসলামই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সফলতা লাভ করেছে। আজও ইসলামী রীতিনীতি অনুসরণ ও পালনের মাধ্যমেই পৃথিবীর বুকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
আপনার মতামত লিখুন