আজি হতে শতবর্ষ আগে — সুভাষ চৌধুরী


Admin প্রকাশের সময় : মার্চ ১৬, ২০২১, ৯:২৯ অপরাহ্ন / ৩৫১
আজি হতে শতবর্ষ আগে — সুভাষ চৌধুরী

আজি হতে শতবর্ষ আগে

সুভাষ চৌধুরী

‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি। সেই শান্তির প্রহর গুনি’। সম্ভবতঃ এই অঙ্গিকার করেই ভ‚মিষ্ঠ হয়েছিলেন তিনি। তিনি তার জীবনব্যাপী দুঃখী মানুষের কাছে থেকে তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শোষিতের পক্ষে থেকে শোষকের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন।নিজের সুখ শান্তি ও পারিবারিক সুখ শান্তিকে পশ্চাতে রেখে তিনি মাঠের মানুষের শান্তি সুখ আর স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন।

আজ সেই ১৭ মার্চ । কালজয়ী একটি দিন। এদিন টুঙ্গিপাড়ার এক অজপাড়া গাঁয়ে বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের ঘরে ভ‚মিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। ১৯২০ এর সেই ১৭ মার্চ থেকে আজ ২০২১ এর ১৭ মার্চ। একটি শতবর্ষ পার করলেন তিনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের অর্জিত বহুকাংখিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। আর সেই সাথে জাতি পালন করছে পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। এরই মধ্যে আমরা পালন করেছি বঙঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের দুনিয়া কাঁপানো ভাষনের ৫০ বছর। দুর্ভাগ্যের বিষয় বঙ্গবন্ধু তার জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী দেখে যেতে পারেন নি। ঘাতক চক্র তাকে আগেই নির্মম আঘাতে সরিয়ে দিয়েছে। তবু বঙ্গবন্ধু ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তিনি বিশে^র কোটি কোটি নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের কাছে এবং মুক্তি ও স্বাধীনতাকামী মানব সন্তানদের কাছে এক প্রেরণা, এক উদ্দীপনা এবং এক আন্দোলনের নেতা হিসেবে রয়েছেন। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।

টুঙ্গিপাড়ার সেই অজ গ্রামে জন্মেও তিনি সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেননি। শিশু বয়সে তিনি যখন স্কুল পড়–য়া তখন তার বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসা স্কুল ইন্সপেকটর শিক্ষকদের কাছে সব সমস্যার কথা জানবার পর ছাত্রদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ‘তোমাদের সমস্যা কি’। ছাত্রদের মধ্য থেকে সেদিনের সেই লিকলিকে চেহারার শিশু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ‘ আমাদের স্কুলে যাতায়াতের পথ বর্ষাকালে কর্দমাক্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া সাঁকো পার হয়ে ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে আসতে হয়। এর সমাধান চাই’। ছোট্ট মুজিবের সেদিনের এই সাহসী বক্তব্যে স্কুলইন্সপেক্টর বিষ্মিত হয়ে যান। তিনি এই সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন বলে কথা দেন এবং বলেন এই শিশুটি একদিন বড় মাপের এক মানুষে।

পরিণত হবে। স্কুল ইন্সপেকটরের সেদিনের কথা বাস্তবে রূপ লাভ করে। সেই ছোট্ট মুজিবর পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই হলেন জাতির পথপ্রদর্শক, বাঙ্গালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা এবং মহান স্বাধীনতার স্থপতি।
‘ রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’ বঙ্গবন্ধুর ভাষনে ফুটে ওঠা এই মুক্তি চেতনার প্রতিশ্রæতি সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। একই সাথে বিশে^র সব নিপীড়িত মানুষের কাছে তা ছিল এক অভয় বাণী। এক পথ নির্দেশনা।
রাজনৈতিক সংগ্রামের মুখে এবং পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষন থেকে দেশকে মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু বহু নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তিনি ১৩ বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। তার সামনে লক্ষ জনতা, পেছনে কামানের গোলা ও বন্দুক , মাথার ওপরে শত্রæবাহিনীর বিমান নজরদারি এমন অবস্থার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু তার প্রতিশ্রæতি থেকে এতোটুকু বিচ্যূত না হয়ে জনতার ‘সংগ্রাম চলবেই’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে জেলে পুরে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে তার প্রাণনাশ করার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ছিল সম্মোহনী শক্তি। তিনি মানুষকে আকৃষ্ট করার সব কৌশল জানতেন। তার ছিল অদম্য সাহস। তার ভাষা ছিল বজ্রকঠিন। লিবিয়ার কর্ণেল গাদ্দাফিকে মাত্র ৩৫ মিনিটের সংলাপে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে মত দেওয়ার সায় দিতে রাজী করিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯ মিনিটে যে ভাষন দিয়েছিলেন তাতে শব্দ সংখ্যা ছিল ১৩০৮ টি। সে ভাষন ছিল অলিখিত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তার ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’ এর লিখিত ভাষনে শব্দ ছিল ২৭২ টি। সময় ছিল তিন মিনিট। অপরদিকে মার্টিন লুথার কিং তার ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ ভাষন দিয়েছিলেন তাতে শব্দ ছিল ১৬৬৭ টি। সময় ছিল ১৭ মিনিট। সেটিও ছিল লিখিত ভাষন। তবে বঙ্গবন্ধুর অলিখিত তেজোদীপ্ত ভাষনে স্বাধীনতার যে ডাক ছিল তা সারা বিশে^র মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি উজ্জীবনী, আবেদনময়ী, সাহসী, সংগ্রামী , প্রেরণাদায়ক এবং শক্তিদায়ক চিল। শব্দচয়ন, বাংলাদেশের মেঠো ভাষার কঠিন বাক্য , বজ্রকন্ঠের দৃপ্ত উচ্চারন অথচ সাবলীল ভাষা সব মানুষের রক্তে দোলা দিয়েছিল। এই ভাষনকে সামনে রেখে বাঙ্গালি জাতি এই ভ‚খন্ড থেকে হানাদারদের বিতাড়নের প্রাণশক্তি লাভ করেছিল। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে নয় মাসের রক্তঝরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা। আর এ কারণেই ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্লড।
ইন্টারন্যাশনাল রেজিষ্ট্রারে’ অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবিলা করতে হবে’ এর অর্থ মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে জাগরিত করে তোলা। তাদের সংগঠিত করে মাতৃভ‚মির স্বাধকার আদায় করা। আলজিয়ার্স সম্মেলনে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘বিশ^ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক. শোষক। ২. শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে’।
অত্যন্ত দুরদর্শী মানুষ ছিলেন তিনি। জাতিকে আন্দোলনমুখী করে তোলা, পাকিস্তানি শাসকদের রাজনৈতিক ফাঁদে ফেলে বিতাড়নের সমুদয় কৌশল তার জানা ছিল। তাদেরকে তিনি বীর জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে শত্রæদলনের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন । পাকিস্তানিদের শৃংখল থেকে বাঙ্গালি জাতিকে মুক্ত করতে টানা ২৩ বছর আন্দোলন সংগ্রাম করে জেল জুলুম সহ্য করেছেন বঙ্গবন্ধু।বঙ্গবন্ধু জাতির পথপ্রশদর্শক। তার জন্ম আমাদের দিয়েছে স্বাধীনতা। তার কর্ম আমাদের দিয়েছে মুক্তির সনদ। বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল প্রেরণাময়। তার ডাক ছিল বজ্রকন্ঠী। তার তর্জনী ছিল পাকিস্তানি শাসক শোষকদের জন্য হুংকার। আজি হতে শতনর্ষ আগে জন্মেছিলেন তিনি।
এই মহামানবের জস্মদিনে সমগ্র জাতি অবনত মস্তকে বলছে ‘ শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রনি। বাংলাদেশ , আমার বাংলাদেশ’। মুজিব জন্ম শতবর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আজ একাকার। মহাকালের ইতিহাস। মহাকালের বৃন্তে প্রস্ফুটিত পুষ্প বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমনই একটি নিষ্পাপ পুষ্প যার পাপড়ি ঝরে না কোনোদিন। যার বৃন্ত বাতাসে দুমড়ায়না। তর্জনী উচিয়ে এক গাল হাসির ফোয়ারা নিয়ে পূর্ণ এ পুষ্প। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উত্থিত এই একটি নাম বাংলাদেশের মাটি ফুঁড়ে মাথা উঁচু করা সে এক মহীরুহের অবয়ব, ফুলের বাগানে সর্বোচ্চ শির নিয়ে দন্ডায়মান সেতো জাতির জনক , সেতো বঙ্গবন্ধু, সেতো শেখ মুজিবুর রহমান। তার মৃত্যু হয়না কোনোদিন।

সুভাষ চৌধুরী , সাবেক সভাপতি, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব।

মুক্তমত বিভাগের আরো খবর

আরও খবর